ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টার বলেন যদি আমেরিকা বা তাদের মিত্র দেশগুলো ইরানের ওপর আক্রমণ করে তাহলে পারমাণবিক তৈরি করতে বাধ্য হতে হবে। এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হলো। খবরটি বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের লেখা।
যদি মার্কিন হামলা হয়, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে ‘বাধ্য হবে’ ইরান: খামেনির উপদেষ্টা।
তেহরান, ১ এপ্রিল ২০২৫: ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা সতর্ক করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের ওপর সামরিক হামলা চালায়, তাহলে তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগিয়ে যেতে বাধ্য হবে। এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে এলো, যখন মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ক্রমশ চরমে উঠছে এবং ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়ে উঠেছে। উপদেষ্টার এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে, কারণ এটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ককে নতুন মোড় দিতে পারে।
![]() |
"ঘিবলি স্টাইলে ইরানের মানচিত্র ও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের শৈল্পিক চিত্রণ" |
ইরানের বিপ্লবী গার্ডের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং খামেনির কার্যালয়ের কাছাকাছি একটি সূত্র হিসেবে পরিচিত এই উপদেষ্টা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, তেহরানে একটি বন্ধদ্বার বৈঠকে এই মন্তব্য করেছেন বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, “আমরা শান্তি চাই, কিন্তু যদি আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আসে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সব পথ খোলা রাখতে হবে। পারমাণবিক অস্ত্র আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চূড়ান্ত হাতিয়ার হতে পারে।”
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ইতিহাস।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগের কারণ। ২০১৫ সালে ইরান ও বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (জেসিপিওএ) বা ইরান পারমাণবিক চুক্তির মাধ্যমে তেহরান তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম সীমিত করতে সম্মত হয়েছিল। বিনিময়ে, ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এরপর থেকে ইরান ধীরে ধীরে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান এখন পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে পৌঁছায়নি। তবে গত কয়েক বছরে তারা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করেছে, যা শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এই অগ্রগতি পশ্চিমা বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, এবং ইসরায়েল বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে তারা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে সফল হতে দেবে না।
ইরানের কেন এই হুঁশিয়ারি?
খামেনির উপদেষ্টার এই মন্তব্যের পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ক্রমশ শত্রুতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত কয়েক মাসে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ এবং হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত বেড়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার পরিকল্পনা করতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও এই বক্তব্যের পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। দেশটি গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল রপ্তানি কমে গেছে, মুদ্রার মান হ্রাস পেয়েছে এবং জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই বক্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “ইরানের এই ধরনের হুমকি গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগোতে দেব না।” তিনি আরও জানান, ওয়াশিংটন তার মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একটি বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, “আমরা সব পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানাই এবং কূটনৈতিক সমাধানের পথ খোলা রাখতে বলি।”
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, “ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে এগোয়, আমরা চুপ করে বসে থাকব না। আমাদের নিরাপত্তা প্রথম।” এদিকে, রাশিয়া ও চীন এখনও এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে তারা ঐতিহাসিকভাবে ইরানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
আরও খবর পড়ুনঃ তুরস্ক থেকেও ‘কান’ কিনতে ‘চলেছে’ পাকিস্তান
সম্ভাব্য পরিণতি কি হতে পারে!
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান যদি সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে এগোয়, তবে এটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করতে পারে। সৌদি আরব, তুরস্ক এবং মিসরের মতো দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার জন্য একই পথে হাঁটতে পারে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের সামরিক হামলার সম্ভাবনা বাড়বে, যা একটি বৃহৎ আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ইরানের জনগণের মধ্যেও এই বক্তব্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। কেউ কেউ এটিকে শত্রুদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান হিসেবে দেখছেন, আবার অনেকে আশঙ্কা করছেন যে এটি দেশকে আরও বিচ্ছিন্নতা ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে।
বিশেষ সুত্রঃ সংবাদ মাধ্যম।।
উপসংহার
খামেনির উপদেষ্টার এই বক্তব্য একটি কৌশলগত হুঁশিয়ারি হতে পারে, যার উদ্দেশ্য পশ্চিমা বিশ্বকে চাপে রাখা। তবে এটি যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে বিশ্ব একটি নতুন সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। বর্তমানে সবার দৃষ্টি তেহরান, ওয়াশিংটন এবং জেরুজালেমের দিকে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা এখনও অস্পষ্ট। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি আরও জটিল হতে চলেছে।
বিশেষ সুত্র: খবর টাইমস অব ইসরায়েল
আপডেট পেতে, আমাদের সাথেই থাকুন ! পাশে থাকুন ৷ খবরের সাথেই থাকুন ! Breaking News Todays সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি: Facebook, Facebook page, Whatsapp Group.
0 মন্তব্যসমূহ