ভারত ও ইসরায়েলের পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের পরিকল্পনা: কী ঘটেছিল জানুন।
ভূমিকা
পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তি অর্জন বরাবরই ভারত ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল। বিশেষ করে ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষার পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ভারত ও ইসরায়েল একসময় যৌথভাবে পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিল, তবে এটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এই প্রতিবেদনে সেই পরিকল্পনার বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
![]() |
"ভারত ও ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের পারমাণবিক কেন্দ্রের উপরে, প্রতীকী চিত্র" |
পরিকল্পনার পটভূমি
১৯৮০-এর দশকে পাকিস্তান তার পারমাণবিক কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছিল। এর প্রধান কেন্দ্রে ছিল খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ (KRL) এবং কাহুটা গবেষণা কেন্দ্র, যেখানে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন হচ্ছিল।
এই সময়ে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে তার শত্রু রাষ্ট্র ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতে সফল হয়েছিল। ১৯৮১ সালে ইসরায়েল 'অপারেশন অপেরা' নামে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করেছিল। এর পরে, ইসরায়েল পাকিস্তানকেও একইভাবে আঘাত করার পরিকল্পনা করেছিল। ভারত এই পরিকল্পনায় ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী ছিল।
পরিকল্পনার বিশদ বিবরণ
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ শুরু হয়। ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা 'মোসাদ' এবং ভারতের 'র' (RAW) একসঙ্গে পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্প ধ্বংসের জন্য পরিকল্পনা করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী:
- ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করবে এবং কাহুটা স্থাপনায় হামলা চালাবে।
- ভারত, পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যস্ত রাখবে যাতে ইসরায়েলের বিমানগুলো সহজে হামলা করতে পারে।
- ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর F-16 এবং F-4 ফ্যান্টম জেট বিমানগুলো এই হামলা চালাবে।
কেন পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো?
১. পাকিস্তানের প্রস্তুতি
১৯৮৪ সালের দিকে পাকিস্তান ভারতের এই পরিকল্পনার ব্যাপারে ধারণা পেয়ে যায়। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ISI জানতে পারে যে ভারত ও ইসরায়েল যৌথভাবে কাহুটা গবেষণা কেন্দ্রের ওপর হামলার ছক কষছে। এরপর পাকিস্তান তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। ভারত কিছু টা চাপে পরে যায়। যদি পূর্ণ শক্তি দিয়ে পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু করে দেয়। কারণ সেই সময় আমেরিকা মিত্র দেশ পাকিস্তান।
২. যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ
এই পরিকল্পনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা CIA আগেভাগেই জানতে পারে এবং ভারত ও ইসরায়েলকে কঠোরভাবে সতর্ক করে। যুক্তরাষ্ট্র তখন পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিল, কারণ সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল। যুক্তরাষ্ট্র চায়নি দক্ষিণ এশিয়ায় আরও একটি সংঘাত শুরু হোক।
৩. কূটনৈতিক জটিলতা
ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে তখনও পূর্ণমাত্রার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। সেই সময়ে ভারত ইসরায়েলের সাথে গোপনে সামরিক সহযোগিতা করলেও প্রকাশ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেনি। ফলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৪. পাকিস্তানের পাল্টা হুমকি
পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে কাহুটা পারমাণবিক কেন্দ্রের উপর হামলা হলে তারা ভারতে বড় ধরনের প্রতিশোধমূলক হামলা চালাবে। পাকিস্তানের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক হুঁশিয়ারি দেন যে এই ধরনের হামলা হলে "পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ" শুরু হবে। এছাড়াও, পাকিস্তান স্পষ্ট করে জানায় যে তারা যেকোনো মূল্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, “আমরা ঘাস খেয়েও থাকবো, কিন্তু পারমাণবিক বোমা তৈরি করবো।”
৫. ভারতের কৌশলগত হিসাব
ভারত ভালো করেই জানত যে পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্পের উপর হামলা চালালে পাকিস্তান পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে। এটি শুধুমাত্র সীমিত সামরিক সংঘাতের মধ্যে আটকে থাকবে না, বরং একটি বৃহৎ যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে। ভারতের কাছে এটি একটি বড় ঝুঁকি ছিল, কারণ পাকিস্তান তখন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সমর্থন পাচ্ছিল। তাই ভারত শেষ পর্যন্ত সরাসরি হামলার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে।
আরও খবর পড়ুনঃ যদি মার্কিন হামলা হয় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে‘বাধ্য হবে’ ইরান : খামেনির উপদেষ্টা।
পরিণতি ও বর্তমান প্রভাব
যদিও ভারত ও ইসরায়েল একসঙ্গে পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে পারেনি, তবে এটি পাকিস্তান, ভারত ও ইসরায়েলের সম্পর্কের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। পাকিস্তান এই ঘটনার পর তার সামরিক ও পারমাণবিক নিরাপত্তা আরও জোরদার করে।
উপসংহার
ভারত ও ইসরায়েলের যৌথ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত। কিন্তু বিভিন্ন কূটনৈতিক, সামরিক ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে এই পরিকল্পনা সফল হয়নি। বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও ইসরায়েল সবাই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। এই তিনটি দেশের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন আজও বিদ্যমান, তবে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলছে।
আরও খবর পড়ুনঃ তুরস্ক থেকেও ‘কান’ কিনতে ‘চলেছে’ পাকিস্তান
এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে কৌশলগত ও সামরিক পরিকল্পনা কেবল শত্রুপক্ষের শক্তির ওপর নির্ভর করে না, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির প্রভাবও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আপডেট পেতে, আমাদের সাথেই থাকুন ! পাশে থাকুন ৷ খবরের সাথেই থাকুন ! Breaking News Todays সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি: Facebook, Facebook page, Whatsapp Group.
0 মন্তব্যসমূহ